তিতুমীর নামটি হবার পিছনের গল্প এবং তার সর্ম্পূণ ইতিহাস।
![]() |
শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ তিতুমীর |
শহীদ তিতুমীর একটি ইতিহাস ও একটি নাম যা মানুষকে আজও অনুপ্রেরণা দেয়। পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতিপ্রিয় নাম শহীদ তিতুমীর। স্বাধীনচেতা পালোয়ান তিতুমীরকে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী অসম্ভব ভয় পেত। ব্রিটিশের পালিত স্থানীয় জমিদাররা তাঁর নাম শুনে হতো আতঙ্কিত। ব্রিটিশ বেনিয়ার অত্যাচার থেকে এ দেশের অসহায় মানুষকে মুক্তির জন্য তিনি আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। সাহসী তিতুমীর ইসলামের ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার সাধন এবং শিরক-বিদয়াত থেকে মুসলমানদের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। তিতুমীরের এ লড়াই পাক-ভারত মুসলিম ইতিহাসের এক অনন্য বীরত্বগাঁথা এবং এক গৌরবময় অধ্যায়। মুসলিম মানসপটে শিহরণসঞ্চারী এক স্বাপ্নিক পুরুষ ছিলেন তিতুমীর। তাঁর অসীম সাহস ও ক্ষিপ্রতা আমাদের হৃদয়াবেগ প্রাণিত করে। নারকেলবাড়িয়ায় তাঁর ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা ইতিহাসের পাতায় এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। তিতুমীর, যাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী (১৭৮২-১৮৩১)। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী। তিনি জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও তাঁর বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।তিতুমীর নামেই তাঁকে সবাই চিনলেও এটি ছিল তাঁর ডাক নাম। তার প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী।
![]() |
তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। |
শিশুকালে তিতুমীরের একবার কঠিন অসুখ হয়েছিল। রোগ সারানোর জন্য তাকে দেওয়া হয়েছিল ভীষণ তেতো ওষুধ। এমন তেতো ওষুধ শিশু বা বৃদ্ধ কেউই মুখে নেবে না। অথচ শিশু তিতুমীর বেশ খুশিতেই দশ বার দিন এই তেতো ওষুধ খেয়েছিল। তেতো খেতে তার আনন্দ। তাই বাড়ির সবাই অবাক হয়ে তার ডাক নাম রেখেছিল তেতো। তেতো থেকে তিতু। তিতুর সঙ্গে মীর লাগিয়ে তিতুমীর নাম রাখা হয়েছিল। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী শহীদ (১৭৮৬-১৮৩১) যখন মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ব্রিটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর শিখদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত ঠিক তখনই বাংলাদেশে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর নামক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সিপাহসালারের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে জুলুম শোষণ ও নির্যাতনের মূলোৎপাটনের সংগ্রামে যে ক’জন দেশপ্রেমিক অস্ত্র ধারণ করে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমর হয়ে রয়েছেন, তিতুমীর তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রদর্শিত বীরত্বপূর্ণ কর্মকান্ড-স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আজও এদেশবাসীকে যুগপৎ অনুপ্রাণিত করে। স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদ ও নির্যাতনমূলক শাসন নির্মূল করে এ দেশে আদর্শভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার জীবনের প্রধান স্বপ্ন।
বাংলা অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মাটি আর মানুষের খুব কাছাকাছি থেকে যে ক’টি আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হাজী শরীয়তুল্লাহ্র ফরায়েজী আন্দোলন। ইংরেজ শাসনামলে জমিদার ও নীলকরদের শোষণ-নির্যাতনে সাধারণ প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে হাজী শরীয়তুল্লাহ কৃষক-প্রজাদেরকে জালেম জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ফরায়েজী সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে মানুষের সামাজিক জীবন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং সবাইকে আত্মপ্রতিষ্ঠার বাণী শিক্ষা দান, এই সংস্কার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল। হাজী শরিয়তুল্লাহ্র ফরায়েজী আন্দোলনের মতো ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে মীর নেসার আলী তিতুমীরও একটি প্রজা আন্দোলন গঠন করেন। ব্যবধান শুধু এতটুকু যে, হাজী শরিয়তুল্লাহ আরবের সংস্কার আন্দোলনের নেতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন আর তিতুমীর ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর আদর্শে অনুপ্রাণিত।
সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগণা জেলার বারাসাতের অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে ১৭৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী আর মা আবেদা রোকাইয়া খাতুন। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। বাল্যকালে তিনি পড়ালেখা করেন সে সময়ের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন পন্ডিতের কাছে। আরবী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে কোরআনের হাফেজ হন। পড়ালেখা শেষ করে তিনি মক্কা গমন করেন। সেখানে তাঁর সাথে দেখা হয় উপমহাদেশের বিশিষ্ট সংস্কারক সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভির সাথে। তিনি ১৮২১ সালে সাইয়্যেদ বেরলভির সাথে মক্কা, মদীনা, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিশর, আফগানিস্তান সফর করেন এবং সমকালীন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত ও মতবিনিময়ের সুযোগ পান। এই ভ্রমণেই তিনি মুসলিম বিশ্বের সমকালীন সমস্যা, সম্ভাবনা ও করণীয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মপ্রেরণায় তিতুমীর চিন্তাচঞ্চল হয়ে ওঠেন। ইসলামের প্রকৃত রূপায়ণের আশা নিয়ে তিতুমীর মক্কা-মদিনা থেকে দেশে ফিরে এলেন। ফিরে এলেন তিতুমীর আঁধারঘেরা লাঞ্ছিত বাংলার বুকে। দীনের যথার্থ শিক্ষা মানুষের কাছে তুলে ধরাছেন, তাদেরকে।
Comments
Post a Comment
আপনার মূল্যবান মতামত প্রদান করুন